শনিবার, এপ্রিল ২৬

‘শোন, শোন, আমি তোর চামড়া ছুলে ফেলে দিতে পারি, তুই রেডি থাকিস। আর ঢাকার রমনা থানায় যেয়ে শুনে দেখ, ইন্সপেক্টর পায়েল কী ছিল। আমার হিস্ট্রি শুনে আয়, আমি কী জিনিস’। কথাগুলো যশোরের চৌগাছা থানার নতুন ওসি পায়েল হোসেনের। তিনি অকথ্য ভাষায় চৌগাছার একজন ব্যবসায়ীকে মোবাইল ফোনে গালিগালাজ দিচ্ছিলেন-এমন একটি ক্লিপ সংরক্ষিত রয়েছে গ্রামের কাগজে।
অন্য একটি ঘটনায় ওসি পায়েল হোসেন এক আসামির মাকে বলেছেন, ‘তোর মেয়ে কই, মেয়েকে নিয়ে আয়’। তিনি দুই লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ওই মাকে এমন কথা বলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী নিজে। শুধু ব্যবসায়ী কিংবা আসামির স্বজনেরা নন, অভিযোগ উঠেছে চৌগাছা থানার এই ওসি সেখানে যোগদানের পর যা ইচ্ছে তাই করছেন। ইচ্ছা মতো এর ওর কাছে চাঁদা দাবি করছেন। তার কথার বাইরে গেলে ওই ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে পোস্টার তৈরি করে টাঙিয়ে দিচ্ছেন থানা চত্বরে।
ওসির কাছে আইনি সেবা পাওয়া দূরে থাক, সেবা নিতে যেয়েই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে-এমন অভিযোগ এখন মুখে মুখে।
চৌগাছার জলকা মাধবপুরের বাবুল জানান, গত ১৫ ডিসেম্বর তার ভাই ইসলাম হঠাৎ নিখোঁজ হন। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর তিনি চৌগাছা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ভাইকে খুঁজে পেতে তিনি ও চৌগাছার ব্যবসায়ী জীবনকে সাথে নিয়ে ওসির সাথে দেখা করেন। এসময় ওসি তাদের কাছে ভাইকে খুঁজে দেবে বলে দুই লাখ টাকা দাবি করেন।
ব্যবসায়ী জীবন খান লিপু জানান, ইসলামকে খুঁজে পাওয়া গেছে বলে জানিয়ে টাকা দাবি করেন ওসি নিজেই। ইসলামকে আনতে ঢাকায় যেতে হবে বলে জানান তিনি। গাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ ওসিকে তার বাংলোতে যেয়ে ৫০ হাজার টাকা দেন তারা। ওসি ওই টাকা নেন। কিন্তু কোনো কাজ করেন না। কয়েকদিন পর তিনি আবারও যান ওসির কাছে। এসময় ওসি আরও এক লাখ টাকা দাবি করেন। তাকে বলা হয় ইসলামকে পাওয়া গেলে টাকা দেয়া হবে। এ কথা শুনেই ক্ষিপ্ত হয়ে যান তিনি। এরপর জীবন ও বাবুলের ছবি তুলে থানা চত্বরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে দেন। তাদেরকে থানার দালাল আখ্যা দিয়ে পোস্টারও ঝুলিয়ে দেন তিনি।
জীবন বলেন, ‘তাকে আমরা যখন টাকা দিয়েছি সেসময় একটি ফুটেজ আমরা রেখেছিলাম। এছাড়াও তার সাথে কথা হয়েছে সেসব ভয়েজ রেকর্ডও রয়েছে। এখনো পর্যন্ত ইসলামকে খুঁজে পওয়া যায়নি। ওসি এখন সেই ৫০ হাজার টাকাতো ফেরৎ দিচ্ছেন না, উল্টো হয়রানি করছেন’।
এদিকে, দুই লাখ টাকা দেয়ায় ছেলে পারভেজ হোসেন সোহাগকে বৈদ্যুতিক শক ও শারীরিক নির্যাতন করে আটকের ৩২ ঘণ্টা পর সাজানো তিনটা মামলা দিয়ে সোমবার চালান দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চৌগাছা উপজেলার মাসিলা গ্রামের ভুক্তভোগীর মা সাফিয়া বেগম। এ অভিযোগ চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পায়েল হোসেনের বিরুদ্ধেই।
সোমবার দুপুরে যশোরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোহাগকে দেখতে এসে সাফিয়া বেগম বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমার ছেলে একটি মোটরসাইকেল কেনেন। শুক্রবার দুপুরে চৌগাছা থানা পুলিশ যেয়ে আমার ছেলেকে ধরে আনে। পরে থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ জানায় আমার ছেলে মোটরসাইকেল চুরি করে এনেছে’। তাকে জানানো হয় সোহাগকে ছাড়াতে দুই লাখ টাকা লাগবে। আর যদি চাহিদা মতো টাকা না দেয়া হয় তাহলে চুরি, ডাকাতি ও মাদকের মামলা দিয়ে চালান দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, যার কাছ থেকে গাড়ি কিনেছিল তাকেও ওসির কাছে আনা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই টাকা ছাড়া ছাড়বেন না বলে জানান ওসি। এসময় মোবাইল ফোনে কথা বলেন সোহাগ। ফোনে ওপাশ থেকে সোহাগ জানান, পুলিশ তাকে বৈদ্যুতিক শক দিচ্ছে, লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারপিট করছে। ছেলে সোহাগ, ‘মা আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।
সাফিয়া বেগম কাদতে কাদতে বলেন, ওসি পায়েল তাকে ও তার মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে ওসির কাছে নিয়ে আসতে বলে। এক পর্যায়ে রোববার রাতে সোহাগকে ৩২ ঘণ্টা পর মোটরসাইকেল চুরি, ডাকাতির প্রস্তুতি ও তিন কেজি গাঁজা উদ্ধার দেখিয়ে চালান দেয়া হয়’।
এদিকে, ব্যবসায়ী জীবনকে নিয়ে থানা চত্বরে পোস্টারিং করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ব্যবসায়ীকে কেন দালাল বলা হল তার প্রতিবাদে সংঘটিত হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ওসি পায়েল চৌগাছা থানায় যোগদানের পর থেকেই যা ইচ্ছে তাই করছেন। তিনি নিয়মিত অফিস না করে বাংলোতে থাকেন। আর সেখানেই তৈরি করেছেন টর্চার সেল। পছন্দমত চাঁদা না দিলে যাকে তাকে সেখানে ডেকে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে ওসি পায়েলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, জীবন ও বাবুল চিহ্নিত দালাল। তারা বিভিন্ন সময় আসামির স্বজনদের কাছ থেকে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে টাকা আদায় করে। এজন্য তাদের ছবি টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া অপর একটি ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, সোহাগ মোটরসাইকেল ছিনতাইকারী। ছিনতাই হওয়া মোটরসাইকেলসহ তাকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version